কয়েক বছর ভ্যাট অব্যাহতি চায় মেট্রোরেল, ভাবছে এনবিআর

Passenger Voice    |    ১২:২২ পিএম, ২০২৪-০৩-১৯


কয়েক বছর ভ্যাট অব্যাহতি চায় মেট্রোরেল, ভাবছে এনবিআর

মেট্রোরেল চালু হয়েছে প্রায় ১৪ মাস হতে চলেছে। দিন যত যাচ্ছে, যাত্রীদের কাছে তার জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এই মেট্রোরেলের সেবার ওপর এবার ভ্যাট বসাতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর আগে ২০২৩ সালের মে মাসে মেট্রোরেলের সব ধরনের যাত্রী সেবার ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেয় এনবিআর, যা চলতি বছরের জুনে শেষ হবে। ফলে ১ জুলাই থেকে মেট্রোরেলে যাত্রী সেবার ওপর ভ্যাট দিতে হবে। তবে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বলছে, মেট্টোরেল সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প। মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেও যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে মেট্রোর ভাড়া বাড়ানো হয়নি।

মেট্রোরেল চালুর পর যানজট ও কার্বন নিঃসরণ কমতে শুরু করেছে। দ্রুতগামী, নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, সময় সাশ্রয়ী, বিদ্যুৎচালিত, পরিবেশবান্ধব ও দূরনিয়ন্ত্রিত এই সেবার ওপর কয়েক বছর ভ্যাট অব্যাহতি চেয়েছে মেট্টোরেল কর্তৃপক্ষ। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট গণপরিবহন  ব্যবস্থা মেট্রোরেলের সেবার ওপর ভ্যাট না বসাতে সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তবে এনবিআর বলছে, মেট্রোরেল সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প এতে ভ্যাট অব্যাহতি বা ভ্যাট বসানোর বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

এনবিআর সূত্রমতে, মেট্রোরেলের যাত্রী সেবার ওপর ভ্যাট বসানোর বিষয়ে গত ৪ মার্চ ভ্যাট ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেট ও ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) মধ্যে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মেট্রোরেল সেবার ওপর ভ্যাট না করার যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়। সভায় মেট্রোরেলকে আরও কয়েক বছর ভ্যাট অব্যাহতি দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। তবে ভ্যাট ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেটের কর্মকর্তারা বলেছেন, অব্যাহতি দিতে পারে কেবল এনবিআর। নিয়ম অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মেট্রোরেলের যাত্রী সেবার ওপর ভ্যাট অব্যাহতি কার্যকর থাকবে। ১ জুলাই থেকে ভ্যাট দিতে হবে। এনবিআর যদি ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ না বাড়ায়, তাহলে ১ জুলাই থেকে ভ্যাট আদায় শুরু করবে ভ্যাট কমিশনারেট।

সূত্র আরও জানায়, মেট্রোরেলকে ভ্যাট অব্যাহতি দিতে এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয় ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক। ১১ মার্চ দেয়া এই চিঠিতে মেট্রোরেল সেবার ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়। বলা হয়, ডিএমটিসিএলের লক্ষ্য হলো দ্রুতগামী, নিরাপদ, নির্ভরযোগ্য, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, সময় সাশ্রয়ী, বিদ্যুৎচালিত, পরিবেশবান্ধব ও দূরনিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে ঢাকা মহানগরী ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসন। ডিএমটিসিএলের আওতায় ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত ছয়টি মেট্রোরেল সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য সরকার কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে। যার আওতায় এমআরটি লাইন-৬, এমআরটি লাইন-১ এবং এমআরটি লাইন-৫: নর্দার্ন রুটের নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। অপর একটি মেট্রোরেল প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রক্রিয়াধীন। এমআরটি লাইন-২ এবং এমআরটি লাইন-৪ মেট্রোরেল প্রকল্প গ্রহণের ফিজিবিলিটি স্টাডি করার জন্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা অনুসন্ধান করছে। কোনো প্রকল্পের কাজ এখনও পরিপূর্ণভাবে শেষ হয়নি। এমআরটি লাইন-৬ মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত এক দশমিক ১৬ কিলোমিটার বর্ধিত করার নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে।

বিভিন্ন দেশের মেট্রোরেল পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, শুধু ভাড়ার আয় হতে লাভজনকভাবে মেট্রোরেল পরিচালনা করা যায় না। মেট্রোরেল পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলো ভাড়া থেকে সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ আয় করে থাকে। অবশিষ্ট ৩৫ শতাংশ আয় সরকার ভর্তুকি দেয়। উন্নত দেশগুলোয় ট্রানজিট ওরিয়েনটেড ডেভেলপমেন্ট (টিওডি) ও স্টেশন প্লাজা নির্মাণ করে এই আয়ের সংস্থানও করা হচ্ছে। এখনও ডিএমটিসিএল কোনো টিওডি ও স্টেশন প্লাজা নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়নি। ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত এবং ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত অংশ প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় এখন শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী উত্তরা উত্তর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৩ ঘণ্টা মেট্রোরেল চলাচল করছে। ১৮ ঘণ্টা মেট্রোরেল বাণিজ্যিকভাবে চলাচল এখনও শুরু হয়নি। বর্তমানে মেট্রোরেলের নির্ধারিত দৈনিক লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকেরও কম আয় হচ্ছে। এছাড়া উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে নেয়া ঋণের কিস্তি সুদসহ নিয়মিত পরিশোধ করতে হচ্ছে। মেট্রোরেল আইন, ২০১৫ অনুযায়ী সরকার জনসাধারণের আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনা করে ভাড়া নির্ধারণ করেছে। এ ভাড়া এ রুটে চলাচলকারী বাস ভাড়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে কয়েকটি ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া হয়েছে।

আরও বলা হয়, মেট্রোরেলে কোনো ক্লাস বা শ্রেণি বিন্যাস নেই। সব যাত্রী একই ভাড়ায় একই সুবিধায় মেট্রোরেলে নির্ধারিত গন্তব্যস্থলে আসা-যাওয়া করতে পারেন। সবার জন্য মেট্রোরেল। উল্লেখ্য, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেলওয়ে সেবার ওপর যে যৌক্তিকতায় মূসক আরোপ করা হয়েছে, সেই যৌক্তিকতায় মেট্রোরেলের সেবার ওপর কোনো ধরনের মূসক প্রযোজ্য নয়। মেট্রোরেলের আংশিক বাণিজ্যিক পরিচালনা শুরুর পর বিদ্যুতের মূল্য একাধিকবার বৃদ্ধি পেলেও সরকার জনসাধারণের আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় মেট্রোরেলের ভাড়া এখন পর্যন্ত বৃদ্ধি করেনি। এমআরটি লাইন-৬ পরিপূর্ণভাবে চালু হলে এই রুটে সড়ক যানবাহনের সংখ্যা কমার মাধ্যমে বছরে দুই লাখ দুই হাজার ৭৬২ টন কার্বন নিঃসরণ হ্রাস পাবে। ইতোমধ্যে এমআরটি লাইন-৬ আংশিকভাবে চালু হওয়ায় এই রুটে সড়ক যানবাহনের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। ফলে এই রুটে বায়ুদূষণও কমতে শুরু করেছে। ঢাকা মহানগরের ও তৎসংলগ্ন এলাকার যানজট ও এর ফলশ্রুত প্রভাবে বার্ষিক প্রায় তিন দশমিক আট বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করছেন। এই প্রেক্ষাপটে মেট্রোরেল যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কর্মঘণ্টা সাশ্রয় হচ্ছে। ঢাকা মহানগরবাসীর জীবনযাত্রায় ভিন্ন মাত্রা ও গতি যোগ হচ্ছে।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, এমআরটি লাইন-৬-এর সম্পূর্ণ অংশ পরিপূর্ণভাবে চালু হওয়ার পর মেট্রোরেল পরিচালনাকালে দৈনিক ট্রাভেল টাইম কস্ট বাবদ প্রায় আট কোটি ৩৮ লাখ টাকা এবং ভেহিক্যাল অপারেশন কস্ট বাবদ প্রায় এক কোটি ১৮ লাখ টাকা সাশ্রয় হবে। এই সাশ্রয়কৃত অর্থ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। ঢাকা মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক নির্মিত হলে শুধু ডিএমটিসিএলের অধীন নতুন ১২ হাজার গ্র্যাজুয়েট ও মাঠ প্রকৌশলীর চাকরি হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ফরওয়ার্ড ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প স্থাপন ও সেবা কার্যক্রমের মাধ্যমে আরও চার গুণ নতুন কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে।

এনবিআরের একজন সদস্য বলেন, মূসক আইন অনুযায়ী, এসি ও নন-এসি উভয় ধরনের রেলওয়ে পরিষেবার জন্য ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য। মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২০১২-এর ধারা ২৬-এ শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত (এসি) ও প্রথম-শ্রেণির নন-এসি রেল পরিষেবাÑকোনোটিতেই যাত্রী পরিবহনের জন্য ভ্যাট ছাড় দেয়া হয়নি। মেট্রোরেলকে সরকারের নির্দেশে গত বছর ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। মেট্রোরেলে যাত্রীর চাহিদা বাড়ছে। ফলে এখান থেকে প্রতি বছর অন্তত ১০০ কোটি টাকা ভ্যাট আদায় করা সম্ভব হবে। ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানো হবে কি নামতা আলোচনা করে এনবিআর সিদ্ধান্ত নেবে।

 

প্যা/ভ/ম